আর্থিক ও অর্থনৈতিক, কারিগরি ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক নিজস্ব উদ্যোগে পদ্মাসেতু নির্মাণের কারণে চারটি ফলাফল দৃশ্যমান হচ্ছে । ১) নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো এতো বৃহৎ ভৌত-কাঠামো সফলভাবে নির্মাণের ফলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের আর্থিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে; ২) বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে দারিদ্র বিমোচন, দেশি বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, দেশের উন্নয়নকে আভ্যন্তরীনভাবে সকল অঞ্চলে সুষম বণ্টনসহ দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক (Macro economy) উন্নয়নে এই সেতুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে; ৩) সেতু নির্মাণ, এর মালিকানা ও পরিচালনায় বিদেশি নির্ভরতা না থাকায় জাতীয় স্বার্থ সমন্বিত হয়েছে; ৪) বাংলাদেশের এই উদ্যোগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের দরকষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি সহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ন হয়েছে; এবং ৫) শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
সর্বশেষ ৪১তম স্প্যান বসিয়ে এক হলো মাওয়া-জাজিরা | Padma Bridge | Somoy TV – YouTube
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সকল উন্নয়নশীল দেশ, এমনকি উন্নত বিশ্বের কিছু দেশও বৃহৎ ভৌত-কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিক ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার উপর নির্ভরশীল ছিল। ইতোপূর্বে নির্মিত বাংলাদেশের সকল বৃহৎ ভৌত-কাঠামোই বিভিন্ন বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তায় এবং কখনো কখনো তাদের অংশীদারিতে সম্পন্ন হয়েছে। শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই প্রথম বাংলাদেশ কোনো উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তা ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে এবং অর্থায়নে একটি বিশ্বমানের ভৌত-কাঠামো নির্মাণ হলো।
বৃহৎ সেতুর মতো ভৌত-কাঠামো নির্মাণ ও এর মালিকানার বিষয়ে বিগত তিন দশক ধরে পৃথিবীর অনেক দেশেই নিজস্ব অর্থায়ন ও মালিকানার পরিবর্তে দেশি-বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীর অর্থায়ন এবং ভৌত-কাঠামোগুলোতে তাদের মালিকানায় রাখা হয়। এই ভৌত-কাঠামোগুলোতে রাষ্ট্রীয় কোনো মালিকানা থাকে না । মূলত BOO (Build Own and Operate) এবং BOT (Build, Own and Transfer) এই দুই পদ্ধতিতে এই ধরণের বৃহৎ ভৌত-কাঠামো নির্মাণ, এর মালিকানা, পরিচালনা ইত্যাদি বিষয় নির্ধারিত হয়। পৃথিবীর দেশে দেশে সরকারের সীমিত আর্থিক ও কারিগরি সক্ষমতার কারণেই এই সকল পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে ভৌত কাঠামোতে রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থাকে না । এই ব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই জনসাধারণ ও ভোক্তাগণের পক্ষে প্রকৃত সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয়। এই পদ্ধতিতে ক্ষেত্র-বিশেষে জাতীয় স্বার্থও বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শেখ হাসিনার উদ্যোগে নির্মিত পদ্মাসেতুর উপর কেবল বাংলাদেশেরই মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এই সেতুর উপর কোনো বিদেশি কর্তৃপক্ষের কোনো মালিকানা বা কর্তৃত্ব থাকবে না। চীন শুধু ঠিকাদারি কাজ করছে; দেশের দুই প্রান্তের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সেতুর উপর চীনসহ কোনো বিদেশি কর্তৃপক্ষের কোনো ধরণের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না ।
উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিশ্ব ব্যাংকের জন্ম ১৯৪৪ সালে হলেও মূলত আশির দশক থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি উন্নয়নশীল বিশ্বের অর্থনীতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে আসছে। বিশ্ব ব্যাংক মূলত তাদের Structural Adjustment Programme এর মাধ্যমে তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বে তাদের একধরণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটি অনস্বীকার্য যে, বহুপাক্ষিক ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যেই মূলত কাজ করছে। এক্ষেত্রে তাদের অনেক ইতিবাচক ভূমিকাও রয়েছে। তবে এটি ভুলে গেলে চলবে না, পৃথিবীর অনেক দেশেই এসকল উন্নয়ন সহযোগীদের প্রেসক্রিপশনে সেদেশের জনগণ উপকৃত হয়নি; এর সুবিধাভোগী হয়েছে অন্য পক্ষ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসকল উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শ কিংবা অংশীদারিত্ব সংশ্লিষ্ট দেশের স্বার্থ বিরোধী ছিল। যেমন, ১৯৯৮ সালে বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল, সরকার যাতে ২০০১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রফতানি শুরু করে। এই পরামর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক নানামুখী কৌশল অবলম্বন করেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় স্বার্থে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং ২০০১ সালের জুলাই পর্যন্ত সেটি করতে দেননি। পরবর্তীতে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় এসে দেশ বিরোধী এই পরামর্শ বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল, যদিও শেখ হাসিনার জোরালো বিরোধিতার কারণে খালেদা জিয়া এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
২০১১ সালের জুন এবং ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ সরকারের এক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে আমি ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে বিশ্বব্যাংকের সাথে সভা করেছিলাম— যা মূলত দুই পক্ষের মধ্যে দরকষাকষির সভা ছিল। এ ছাড়াও বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের সাথে আমাদের বিভিন্ন সময়ে সভা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, বিশ্বব্যাংক বরাবরই ঋণ/সহায়তা গ্রহণকারী দেশগুলোর প্রকৃত কল্যাণের চেয়ে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দিতেই বেশি আগ্রহী। তাদের সিদ্ধান্ত সেই রাষ্ট্রের জন্য লাভজনক কি-না সেটি তারা দেখতে আগ্রহী নয়। তাদের নীতিমালার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতেই তারা বেশি আগ্রহী। বিভিন্ন দেশে তাদের খবরদারী প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেক সময় তারা স্ববিরোধী অবস্থানও নেয়। অনেক সময় তারা রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে নামে। পৃথিবীব্যাপী অনেক গবেষণায় উন্নয়ন সহযোগীদের এই ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি বিশ্ব ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় পদে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কেউ কেউ (যেমন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্টিগলিটস ) তাদের লেখায় এটি তুলে ধরেছেন।
বিশ্ব ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা করেছিলো। ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলো, বাংলাদেশে দুই কোটি মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে ওই ভয়াবহ বন্যায় একটি মানুষও না খেয়ে মরেনি। ২০০৯ -১০ সালে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা যখন দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ও জোরালোভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছিলেন, তখন বিশ্বব্যাংক বলেছিলো ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করতে গিয়ে দেশের ম্যাক্রো ইকোনমি ধসে পড়বে। তাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে আমরা ভুল প্রমাণ করেছিলাম। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতসহ সকল খাতে শেখ হাসিনার সাহসী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিস্ময়করভাবে উন্নতি লাভ করেছে।
২০১৬ সালের অক্টোবরে বিশ্বব্যাংকের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে একই মঞ্চে বসে বাংলাদেশের যে প্রশংসা করেছিলেন তার মর্মার্থ হচ্ছে, আর্থ-সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পৃথিবীর অনেক দেশ বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করতে পারে। তার বক্তব্যে মনে হয়েছে, আর্থ সামাজিক সকল সূচকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র। উক্ত অনুষ্ঠানে দর্শক হিসেবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। মঞ্চে উপবিষ্ট রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা সেদিন তার উপস্থিতি, ভাষণ, এমনকি তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে এটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র- বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজ বিশ্ব সভায় নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। ২০১৩ সালের অক্টোবরের ওয়াশিংটন সফরে আমি একটি বিষয় উদঘাটন করেছিলাম যে, ড. ইউনুস মাসিক ফি’র ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত করেছিলেন যার কাজই ছিল স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ক্যাপিটেল হিল আর বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশ বিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করা। একই সময়ে বিএনপি এবং যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠীও যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্টের মাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার আত্মবিশ্বাস, মনোবল আর সুদক্ষ নেতৃত্বের কাছে এসব কিছুই টেকেনি।